সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০৩ অপরাহ্ন
ভিশন বাংলা ডেস্ক: রমজানের পূর্বাভাস নিয়ে হাজির হওয়া শাবান মাস ক্রমেই এগিয়ে যাচ্ছে সমাপ্তির দিকে। ক্ষমার মহান বারতা নিয়ে সমহিমায় হাজির হচ্ছে পবিত্র রমজান। দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ছে রমজানের আগমনী বার্তা। মুমিনের হৃদয়মাত্রই প্রহর গুনছে রমজানের একফালি চাঁদের জন্য। এ মাসে প্রতিটি ইবাদতের প্রতিদান যেমন বহুগুণে বেড়ে যায়, তেমনি সব পাপ ছেড়ে দিয়ে ভালো মানুষ হিসেবে নিজের জীবনকে নতুন করে সাজানোর সুযোগও এনে দেয় রমজান। কোরআনে নিষিদ্ধ জিনিসগুলোকে ‘না’ বলে, নির্দেশিত বিষয়গুলোর চর্চার মহাসুযোগ রমজান। প্রতিটি ইবাদতের সওয়াব বহুগুণে বাড়িয়ে দেওয়ার পাশাপাশি মুমিনের জীবন বদলে দেওয়ার যে মহাসুযোগ রমজান নিয়ে আসে, তা যেন কিছুতেই হাতছাড়া না হয়। সে জন্য প্রয়োজন প্রস্তুতি নেওয়ার। প্রতিটি মুসলমানের উচিত নিজেদের আল্লাহর কাছে নিবেদন করতে রমজানের আগেই যথাযথ প্রস্তুতি গ্রহণ করা। রমজানের প্রস্তুতির ক্ষেত্রে নিম্নের বিষয়গুলো খেয়াল রাখা যেতে পারে।
সমাজে প্রস্তুতি : সামাজিক পরিমণ্ডলে রমজানের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে প্রতিবেশী ও সমাজের লোকজন একে অন্যের সঙ্গে দেখা হলে রমজানের বিভিন্ন ফজিলত ও ইতিবাচক দিক নিয়ে আলোচনা করে। এ ব্যাপারে অন্যকে রোজার বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করা চাই। রমজানের পবিত্রতা রক্ষায় এ মাস আসার আগেই সামাজিকভাবে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে, যেন সমাজটাও হয় ইসলামবান্ধব।
পরিবারে প্রস্তুতি : পরিবারের সদস্যদের রমজানের প্রতি আগ্রহী করে তুলতে রোজার ফজিলতের হাদিস ও এর বিভিন্ন উপকারিতা তুলে ধরে খাবারের টেবিলে বা অন্য কোনো সুযোগে প্রতিদিন কিছু সময় ঘরোয়া তালিম হতে পারে। এ ব্যাপারে মাতা-পিতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন। পরিবারে এমন একটি রুটিন করে নেওয়া প্রয়োজন, যাতে কাজের কারণে ইবাদতে ব্যাঘাত না ঘটে। একটি মুহৃর্তও নফল ইবাদত, তিলাওয়াত ও আল্লাহর জিকিরমুক্ত না হয়।
সন্তানের অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিরাপত্তার জন্য মাতা-পিতা খুবই দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেন, কিন্তু সেই সন্তানই যে পারলৌকিক জীবনে চরম অনিরাপত্তার দিকে চলে যাচ্ছে, সেদিকে অনেক মাতা-পিতাই উদাসীন। নিজের সন্তানকে জাহান্নাম থেকে বাঁচাতে রমজানে সন্তানদের জন্যও মাতা-পিতার পরিকল্পনা দরকার। এ বছর কোন সন্তানের ওপর রোজা ফরজ হলো, তা ভেবে তাদের রোজা রাখতে বলা, যাদের ওপর এখনো রোজা ফরজ হয়নি, কিন্তু কাছাকাছি চলে এসেছে তাদের অন্তত দু-এক দিন পর পর রোজা রাখিয়ে রোজায় অভ্যস্ত করে তোলা উচিত। রমজানে স্কুলগুলো বন্ধ থাকে। কোনো সন্তান কোরআন তিলাওয়াত না জানলে অথবা তিলাওয়াত অশুদ্ধ থাকলে তাকে এ সুযোগে শুদ্ধ তিলাওয়াত শেখানোর ব্যবস্থা গ্রহণ মাতা-পিতার দায়িত্ব। এ জন্য রমজানের আগেই শিক্ষক ঠিক করে রাখা উচিত। অন্তত নামাজ পড়ার জন্য জরুরি পরিমাণ সুরা ও নামাজের মাসায়েল ভালোভাবে শেখানো এ রমজানেই নিশ্চিত করা চাই। পরিবারের প্রত্যেক সদস্যই যেন রমজানে কোরআন তিলাওয়াতের অভ্যাস গড়ে তোলে, সে জন্য পরিবারপ্রধান তাদের উৎসাহিত করবেন। অনৈসলামিক টিভি প্রগ্রামমুক্ত পরিবার গঠনের সিদ্ধান্তও নিতে হবে রমজান থেকে। সন্তানরা যেন ফেসবুক বা টিভিতে অযথা সময় নষ্ট না করে ইবাদতে মনোযোগী হয়, সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। আর রমজানের জন্য সংযমী বাজেট প্রণয়নের সময়ও এখন।
গৃহিণীর প্রস্তুতি : সাহরি ও ইফতার ব্যবস্থাপনা নিশ্চয়ই সওয়াবের কাজ। তবে এগুলোতে লিপ্ত থেকে যেন নিজের ইবাদতে ব্যাঘাত না ঘটে, সেদিকে প্রত্যেক গৃহিণীর খেয়াল রাখা উচিত। কঠিন কোনো কাজ রমজানের জন্য ফেলে না রেখে আগে থেকেই এমন একটি পরিকল্পনা করা, যাতে সংসারের কাজ কিছুটা কমিয়ে সময় বের করে হলেও কিছু সময় কোরআন তিলাওয়াতের জন্য বরাদ্দ রাখা। কিছুতেই যেন ফরজ নামাজ, তারাবি ছুটে না যায়, সে দিকে খেয়াল রাখা। সংযমের মাসে প্রত্যেক গৃহিণীর উচিত অপব্যয় ও অপচয় পরিহার করে পরিবারের অতিরিক্ত খরচ কমিয়ে তা দান-সদকায় ব্যয় করার ক্ষেত্রে স্বামীকে সহযোগিতা করা।
গুনাহ ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তুতি : নিজের ভালোর জন্যই গুনাহগুলো ছেড়ে দিতে হবে। জাহান্নাম থেকে নিজেকে বাঁচাতে গুনাহগুলো চিহ্নিত করে সেগুলোর অভ্যাস ছেড়ে নিজেকে পরিশুদ্ধ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে দৃঢ়সংকল্প করে গুনাহর উপায়-উপকরণগুলোও দূর করে ফেলতে হবে আগেই।
চাকরিজীবীদের প্রস্তুতি : রমজান তো ভালো মানুষ হয়ে যাওয়ার ট্রেনিং কোর্স। চাকরিতে মালিককে না ঠকানো এবং ইবাদত ছেড়ে নিজেও না ঠকার প্রশিক্ষণ নিতে হবে রমজানে। অনৈতিক কোনো অভ্যাস থাকলে তা ছেড়ে দেওয়ার দৃঢ়সংকল্প করতে হবে। কর্মব্যস্ততার ভেতরেও কিভাবে বেশি ইবাদত করা যায়, তার পরিকল্পনা করা উচিত। অফিসের কাজের ফাঁকে ও অফিসে যেতে যে সময় রাস্তায় কাটে, তা-ও ইবাদতে ব্যবহার করতে মোবাইলে কোরআন শরিফসহ বিভিন্ন ইসলামিক অ্যাপস চালু করে তা কাজে লাগাতে পারেন।
প্রয়োজনীয় জ্ঞানার্জনের প্রস্তুতি : প্রত্যেক মুসলমানেরই উচিত রমজানের প্রয়োজনীয় মাসায়েল জেনে নেওয়া। প্রয়োজনে রমজানের আগেই এ বিষয়ে কিছু পুস্তক কিনে নেওয়া যায়, যাতে পরিবারের অন্য সদস্যরাও তা পড়তে পারে। ইতিকাফ করতে আগ্রহীরা এর জন্য প্রস্তুতি নেবেন আগে থেকেই।
ব্যবসায়ীদের প্রস্তুতি : ঈমানদারদের বেশি সওয়াব অর্জনের প্রতীক্ষার বিপরীতে এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী প্রস্তুতি নিতে থাকেন গণমানুষকে ঠকিয়ে বেশি লাভ করার। ভ্রাতৃত্ব ও সৌহার্দ্যের প্রশিক্ষণের মাস রমজানে ভাতৃঘাতী ও নির্মমতার চর্চা করেন তাঁরা। মজুদকরণ বা অপকৌশলে নিত্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে ‘বড়লোক’ হওয়ার স্বপ্নে বিভোর হন। তাঁদের লুটেরা মনোভাবের কারণে যুক্তিগ্রাহ্য কারণ না থাকলেও বাড়ে নিত্যপণ্যের দাম। চাল, ডাল, ছোলা, চিনি, ভোজ্য তেল, খেজুর ইত্যাদির দাম হয় গগনচুম্বী।
একজন মুসলমান ব্যবসায়ীর রমজানকেন্দ্রিক এমন প্রস্তুতি হতে পারে না। কারণ পণ্য মজুদকরণের মাধ্যমে দাম বাড়ালে সে ব্যবসায়ীর প্রতি আল্লাহ তাআলা ক্ষুব্ধ হন এবং সম্পর্ক ছিন্ন করেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি ৪০ দিন খাদ্য মজুদ রাখল সে আল্লাহর কাছ থেকে নিঃসম্পর্ক হয়ে গেল, আল্লাহ নিঃসম্পর্ক হয়ে গেলেন তার থেকে।’ (মুসনাদে আহমাদ : ৮/৪৮১)
সাধারণ ভোক্তাদের জিম্মি করে ‘বিত্তশালী’ হয়ে গেলেও কোনো লাভ নেই। তার এ অবৈধ সম্পদ যেমন পরকালে জাহান্নামে প্রবেশের কারণ হবে, তেমনি দুনিয়ার জীবনেও তা অভিশাপ হয়ে দাঁড়াবে। উপার্জন হারাম হওয়ার কারণে নামাজ, রোজা, হজ, দান-সদকা কিছুই কবুল হবে না। মজুদদারির মাধ্যমে কোটিপতি হলেও তার জন্য দারিদ্র্য অবধারিত। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘কেউ যদি খাদ্য গুদামজাত করে কৃত্রিম উপায়ে সংকট তৈরি করে, আল্লাহ তাকে দুরারোগ্য ব্যাধি ও দারিদ্র্য দ্বারা শাস্তি দেন।’ (ইবনে মাজাহ : ২/৭২৯)
পক্ষান্তরে যারা মজুদদারি না করে স্বাভাবিকভাবে ব্যবসা করল, এ ব্যবসা পরিণত হবে ইবাদতে। তার উপার্জন আল্লাহ তাআলা বরকতময় করে দেবেন। তাকে অপ্রত্যাশিত রিজিক প্রদান করেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘খাঁটি ব্যবসায়ী রিজিকপ্রাপ্ত হয় আর পণ্য মজুদদকারী অভিশপ্ত হয়।’ (ইবনে মাজাহ : ২/৭২৮)
দুনিয়ায় রিজিকে বরকত পাওয়ার পাশাপাশি হাশরের ময়দানেও পুরস্কৃত হবে। তাকে প্রদান করা হবে নবীগণের সঙ্গী হওয়ার পরম সৌভাগ্য। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘সত্যবাদী ও বিশ্বস্ত ব্যবসায়ীদের হাশরে নবীগণ, সিদ্দিকগণ ও শহীদগণের সঙ্গে হাশর হবে।’ (তিরমিজি : ৩/৫১৫)
তাই একজন ব্যবসায়ীর উচিত রমজানকেন্দ্রিক এমন একটি পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি গ্রহণ করা, যেন তার ব্যবসা তাকে নামাজসহ অন্যান্য ইবাদত থেকে বিরত রাখতে না পারে, আবার ব্যবসায় সব ধরনের হারামকে ‘না’ বলে আল্লাহর বান্দাদের জন্য সুলভমূল্যে নিত্যপণ্য সরবরাহ করে ব্যবসাকেও যেন ইবাদতে পরিণত করতে পারে। দুনিয়াবি জীবনে ব্যবসায় আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে বরকত ও হাশরের ময়দানে মহানবী (সা.)-এর সঙ্গী হওয়ার মতো ব্যবসার চর্চা করার প্রস্তুতি নিতে হবে ব্যবসায়ীদের।
রমজানের আর্থিক প্রস্তুতি : রমজান আর্থিক ইবাদতেরও এক অপূর্ব সুযোগ। এ মাসে দৈহিক ইবাদতের মতো আর্থিক ইবাদতেও সওয়াব বেশি। আত্মীয়-স্বজনের কাছে ইফতারসহ নিত্যপণ্য কিনে পাঠানোর মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারি। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘কেউ কোনো রোজাদারকে ইফতার করালে সে উক্ত রোজাদারের সমান সওয়াব পাবে। তবে এতে সে রোজাদারের সওয়াব একটুও কমবে না।’ (তিরমিজি : ৩/১৭১) তাই প্রতিটি মুসলমানের উচিত রমজানকেন্দ্রিক আর্থিক একটা পরিকল্পনা করা। কিছু টাকা জমিয়ে তা দিয়ে অভাবী প্রতিবেশী কিংবা আত্মীয়-স্বজনের ঘরে যেন কিছু ইফতার ও খাদ্যসামগ্রী পাঠানো যায়। যাদের ওপর জাকাত ফরজ, তাদের আগে থেকেই রমজানকেন্দ্রিক জাকাতের পরিকল্পনা করে নেওয়া উচিত। রমজানে ওমরাহর বিশেষ ফজিলত রয়েছে। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘রমজান মাসে একটি ওমরাহ আদায় করা একটি ফরজ হজ আদায় করার সমান।’ (বুখারি : ৩/২২২) এ জন্য অর্থনৈতিকভাবে সামর্থ্যবানদের উচিত রমজানে ওমরাহর নিয়ত করে এর প্রস্তুতি নেওয়া।
লেখক : খতিব, বাইতুশ শফিক মসজিদ, বোর্ড বাজার (আ. গনি রোড), গাজীপুর